পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠীর অসুস্থ মানবতা। অত্যাচারী জুলুমবাজ মিয়ানমার শাসকের অট্টহাসি। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী নির্যাতিত মজলুম রোহিঙ্গাদের চিত্তক্ষোভ বা আর্তনাদ। কখনও’কি পরাশক্তি চীন ও রাশিয়াসহ বিশ্বমোড়লদের বিবেককে দংশন করবে? মিয়ানমার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীরা গত কয়েক যুগ ধরে যেভাবে দুর্বল নিরপরাধ রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন চালিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, এর দায়ভার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এড়াতে পারে কিনা? রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিসহ পৃথিবীর সকল ধর্মের জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দেয়া, বা নিশ্চিত করা। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সেই দায়িত্ব পালনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে, ব্যর্থতার বোঝা ঘাড়ে নিয়ে স্ব-স্ব-দায়িত্বজ্ঞানে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ ত্যাগ করা শিষ্টাচারের নিদর্শন। সাম্প্রতিক জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অখ- টিম কক্সবাজার কুতুপালং শরণার্থী শিবির পর্যবেক্ষণকালে সাংবাদিকেরা তাদের প্রশ্ন করেন। রাখাইন রাজ্যের মুসলিম জাতিগোষ্ঠীকে রোহিঙ্গা হিসাবে স্বীকৃতি দেন কিনা? অধিকাংশ দেশের প্রতিনিধিরা স্বতঃস্ফূত সম্মতি জানালেও, চীন ও রাশিয়া সরাসরি বিব্রত বোধ করেন।

এত্থেকেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, ভেটো রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়া গণহত্যাকারী মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করেছে। জাতিসংঘ মার্কিন দূত নিকি হেলির বক্তব্য থেকেও সে রকমই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যদের দ্বিধাবিভক্তির কারণে অদ্যবধি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করতে পারেনি সংস্থাটি।

রোহিঙ্গা মুসলিম জাতি নিধন, গণহত্যা ও গণধর্ষণের খবর বিশ্ববাসীর অজানার কথা নয়। নিরাপত্তা পরিষদ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয় আমলে নিলে, মিয়ানমার সশস্ত্র সেনাবাহিনীসহ যারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সাথে জড়িত। সেই অপরাধীদের বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে হওয়ার প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। কিন্তু বাস্তবে তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শুধু তাই নয়, তাদের দায়িত্বহীন আচরণে রোহিঙ্গা গণহত্যা বা জাতি হত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সত্যের জোর লুণ্ঠিত হচ্ছে।

এছাড়াও নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমার জান্তা সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সুষ্টু ও নিরপেক্ষ তদন্ত’তো দূরের কথা। উল্টো গণহত্যা ও গণধর্ষণের অপরাধে অভিযুক্ত মিয়ানমার সরকারকে তদন্তের দায়িত্বভার দেয়ায় সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ দায়িত্বজ্ঞানে সচেতন, না অবচেতন। রোহিঙ্গা ট্রাজেডির দীর্ঘদিন পর

নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরকে অনেকেই আইওয়াশ সফর বলেও মন্তব্য করেছে। মিয়ানমার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর বিশ্ব নেতারা মাঝে মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ফলদায়ক কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এই হলো আজকের সভ্যযুগের শাসকগোষ্ঠীর অসুস্থ মানবতার বাস্তব চরিত্র। মানবতার গোড়ায় গলদ থাকলে আগামীতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার ঝুঁকি সামলানো অসাধ্য হয়ে পড়তে পারে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে ধনতন্ত্র ও গণতন্ত্রের নামে শাসকশ্রেনী স্বেচ্ছাচারী শাসন চালাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের ধনতৃষ্ণা ও ক্ষমতার আধিপত্যের প্রভাবে অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক হত্যাসহ ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। তাদের দুঃশাসন ও জনগণের সম্পদ লুটপাট নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা, বা প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। মানবাধিকার সংস্থাসহ যে কয়েকটি সংগঠন আছে। তারাও ফাঁকা বুলি ছাড়া, শাসকশ্রেনীর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে।

বিশ্বের সকল বেসামরিক নিরপরাধ নাগরিকের মানবাধিকার রক্ষাসহ শাসকগোষ্টীর জুলুম নির্যাতন থেকে মুক্ত হতে চাইলে, বিশ্ব নাগরিকদের সচেতন ও সোচ্চার হওয়ার বিকল্প নেই। নাগরিক টু নাগরিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিটি দেশের নাগরিকদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বা সেতুবন্ধন অত্যাবশ্যক। শান্তিপ্রিয় বিশ্ব গড়তে চাইলে যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, সবাইকে এক বাক্যে শিকার করতে হবে। বিপন্ন রোহিঙ্গাসহ মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরণের অধিকার, সেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। মানবাধিকার সব জায়গায় সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার। স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হল এসব অধিকার রক্ষণাবেক্ষন করা। যদিওবা অধিকার বলতে দর্শনগত বিতর্কের বিষয় থাকতে পারে। বিভিন্ন দেশের হতদরিদ্র ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হলে, জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রয়োজনে ‘বিশ্ব নাগরিক সংঘ’ গঠন করা যেতে পারে। সকল দেশের নাগরিক এই সংগঠনের সদস্য হতে পারবে। লেখক মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে! মানবাধিকার রক্ষায় যেখানে জাতিসংঘ ব্যর্থ হবে। সেখানে ‘বিশ্ব নাগরিক সংঘ’ সফল হবে। কারণ সকল ক্ষমতার উৎস দেশের জনগণ। নিবন্ধের শেষ প্রান্তে শিরোনামের সাথে সম্পর্কিত দু’একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা প্রাসঙ্গিক। ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগকারী রাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া যতই মিয়ানমারকে আগলে রাখুক। শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা গণহত্যা ও গণধর্ষণের দায় নিরাপত্তা পরিষদকেই নিতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের বিনয়ের সাথে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। পৃথিবীর স্বল্পোন্নত ও উন্নয়ণশীল দেশগুলোর ওপর দাদাগিরি করতে হলে। সা¤্রাজ্যবাদী মনোভাব পরিহার করে পক্ষপাতশূন্য বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করতে হবে। অন্যথা নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ ও ভেটো ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এছাড়াও তাদের মনে রাখা অতীব জরুরী। গণহত্যা বা জেনোসাইড মানবতাবিরোধী অপরাধ। এটা কোন ধর্ম, জাতি, রাষ্ট্র বা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। গোটা মানবজাতির বিকেককে দংশন করে। মিয়ানমার সামরিক শাসন ও সুচির গণতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পর্যালোচনা করে শেষ করব। ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থান, স্বৈরাচারী সামরিক শাসন জারি। অবৈধ সেনাশাসক ১৯৮২ সালে বিতর্কিত আইনে রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিগোষ্ঠির নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। যা মানবতাবিরোধী অপরাধ, বা রোহিঙ্গা মুসলিম জাতিকে হত্যার সামিল। মিয়ানমার স্বাধীনতা যুদ্ধে রোহিঙ্গা নেতারা প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহন করেছিল। অং সান সুচির কারামুক্তি ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের স্বতঃস্ফূত ভূমিকা অনস্বীকার্য। গণতন্ত্রের ভূত অং সান সুচি হঠাৎ ক্ষমতা পেয়ে ক্ষুধার্ত রাজনীতিবিদে রূপান্তর হওয়াকে খেতাব দেয়া যেতে পারে। রোহিঙ্গা মানবভক্ষণকারিণী এক অদ্ভুত অভিনেত্রী। ক্ষমতার পূজারি সুচির গণতান্ত্রিক সরকারের কুপরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হলো। রোহিঙ্গা মুসলিম জাতি নিধন, বা তাদের সমূলে বিনাশ। ইতিমধ্যে ভেটো রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার ছত্রছায়ায় মিয়ানমার নির্বিঘেœ তা করতে সক্ষম হয়েছে। মিয়ানমার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও ধর্ষণ থেকে রোহিঙ্গা গর্ভবতী নারী, কোমলমতি শিশু, বয়োবৃদ্ধাসহ রাখাইন রাজ্যের মুসলিমরা কেহই রেহাই পাইনি। জীবন বাঁচাতে প্রায় ১২লাখ রোহিঙ্গা বাপ-দাদার আমলের ভিটে-মাটিসহ সহায়-সম্বল ত্যাগ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি, মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালত, যুক্তরাষ্ট্রের জেনোসাইড স্টাডিজ অ্যান্ড প্রিভেনশনের গভেষক অধ্যাপক গ্রেগরিসহ বিশ্ব মানবাধিকার কর্মীরা রোহিঙ্গা মুসলিম জাতি নিধন ও গণহত্যাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, বা জেনোসাইড আখ্যা দিয়ে (অসংখ্য স্বাক্ষ্য-প্রমাণসহ) বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। মিয়ানমার সেনাপ্রধানসহ দোষী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তি না হলে, পুরো বিশ্বকেই মাশুল গুনতে হবে। গোটী কয়েক শাসকগোষ্ঠী ছাড়া বিশ্ব জনমত রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের পাশে রয়েছে। সেটাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা বাংলাদেশকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হবে মিয়ানমার জান্তা সরকার। তবে বাংলাদেশের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি কাম্য নয়। অভ্যন্তরীণ ঝগড়া ব্যতিরেকে মেরুদন্ড শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সাথে নিয়ে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে যাওয়ার আইনি সুযোগ আছে কি’না, তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও ধর্ষনের অপরাধে অভিযুক্তদের তদন্তের বিষয়ে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেটাকে স্বাগত জানিয়ে অনতিবিলম্বে তাদেরকে সহযোগিতা করা বাংলাদেশের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বাণী।

মোবাইল:- ০১৫৫৮৩৬৩৩৪৩

E-mail: siddiquecoxsbazar@gmail.com